গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ১০-১২ শতাংশ মানুষ এ রোগের বাহক; অর্থাৎ প্রায় দেড় থেকে ২ কোটি মানুষ তাদের অজান্তে এ রোগের বাহক।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধযোগ্য নীরব ঘাতক। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া বাহকের সংখ্যা দেড় থেকে ২ কোটি বলে মনে করা হয়। প্রতি বছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার। তবে সচেতনতার অভাব ও শনাক্ত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত এ রোগের বাহক ও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

এ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও অপ্রতুল। বাড়েনি সেবার মান। চিকিৎসা ব্যবস্থা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় সবচেয়ে বেশি অবহেলিত গ্রামের রোগীরা। সংকট রয়েছে বিশেষজ্ঞেও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রতিনিয়িত অন্যের দান করা রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। রোগীরা নিয়মিত রক্ত নিলেও অনেক ধরনের সমস্যা হয়, ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ রোগী পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যানটেশনের মাধ্যমে এই রোগ থেকে মুক্তি মেলে। তবে সেই চিকিৎসা ব্যবস্থাও দেশে গড়ে ওঠেনি। এই রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা ও রোগ শনাক্তে জোর দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হেলাল থ্যালাসেমিয়া রোগী । তার বসবাস রাজধানীতে। বয়স ২২ বছর। দুই বছর বয়স থেকে এ রোগ দেহে বহন করছেন হেলাল। প্রতি মাসে দুই বার হেলালের শরীরে রক্ত দিতে হয়। গত ২০ বছরে প্রায় ৪৮০ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে তাকে। এই রক্তের যোগান দিতে প্রতিবারই দুশ্চিন্তায় ও ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাকে। ইতোমধ্যে তার শরীরে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। পায়ের ও হাতের হাড় ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।

হেলালের ছোট ভাইও থ্যালাসেমিয়া রোগী। হেলাল জানান, সবচেয়ে বেশি কঠিন রক্তের ব্যবস্থা করা। প্রতি মাসে চার ব্যাগ রক্ত লাগে দুই ভাইয়ের জন্য। প্রতিদিনই ডোনার খুঁজতে হয়। রক্ত দানের সুফল সম্পর্কে না জানার কারণে অনেকেই রক্ত দিতে চায় না। হেলালের আকুতি, দেশের সব জাগায়ায় থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা সহজকরণ ও বিনামূল্যে এই রোগীদের ওষুধ পাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। ৬৪ জেলায় যাতে থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে ও এই রোগের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে সঠিক প্রচার-প্রচারণা থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিয়ের আগে অবশ্যই সবার হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস পরীক্ষার করা উচিৎ। তাহলে সন্তান সুস্থ থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসারা বলেন, থ্যালাসেমিয়া মানুষের জীনগত ক্রুটিজনিত রোগ। রোগটির চিকিৎসায় বিভাগীয় শহরে হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া এখনও জেলা-উপজেলা জেলা পর্যায়ে সেবা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এমনকি সেবাদানের জন্য সারা দেশে ১৩৫ জনের মতো রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। এতে করে অধিকাংশ থ্যালাসেমিয়া বাহক শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছেন।

সাম্প্রতিক গবেষণা না থাকলেও বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (বিআরএফ) উদ্যোগে ২০১৭ সালে ‘থ্যালাসেমিয়া ইন সাউথ এশিয়া: ক্লিনিক্যাল লেসনস লার্ন্ট ফ্রম বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা করা হয়। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ১০-১২ শতাংশ মানুষ এ রোগের বাহক; অর্থাৎ প্রায় দেড় থেকে ২ কোটি মানুষ তাদের অজান্তে এ রোগের বাহক। তবে এই সংখ্যা অনেক বেড়েছে বলে অনুমান বিশেষজ্ঞদের।

রক্ত জোগাড় বড় চ্যালেঞ্জ…

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, দেশে চাহিদার মাত্র ৩১ শতাংশ রক্ত সংগ্রহ করা হয় স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতার মাধ্যমে। যে রোগীদের নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন করতে হয়, তাদের প্রতি মাসে ১ থেকে ৪ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করতে হয়। ৮০ শতাংশ পরিবার সন্তানের জন্য নিয়মিত রক্ত জোগাড় করতে সমস্যার মুখে পড়েন এবং দেশে বহুল পরিচিত ব্লাড ডোনার ক্লাব ও সংস্থা থেকে তারা আশানুরূপ সাপোর্ট পান না। কমিউনিটি লেভেলে রক্তের বড় সংকট বাংলাদেশে। রক্তদান কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে মূলত রক্ত সংগ্রহ করা হয়।

এ বিষয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রায় ২ কোটি মানুষ এর বাহক। যাদের চিকিৎসার জন্য মাত্র ১৩৫ জন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।

হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ১ লাখ ১১ হাজার ১১১ জন রোগীর বিপরীতে মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ সেবা দিচ্ছেন, যদিও এই সংখ্যা ধীরে ধীর বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, রোগ নির্ণয়ে রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিস পরীক্ষা করতে হয়। তবে বিভাগীয় শহরের বড় মেডিকেল ছাড়া জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এই পরীক্ষা নেই। সরকারি হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া শনাক্তের পরীক্ষায় ৮০০ টাকার মতো নেওয়া হলেও বেসরকারিতে উচ্চমূল্য নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতির নির্বাহী পরিচালক ডা. একরামুল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে সিবিসি, এইচআইভি, হেপাটইিটিস-বি ও সি, যৌনরোগ ও ম্যালেরিয়া রোগের টেস্ট করাতে হয়। এরপর শুধুমাত্র রক্তের লোহিত কণিকাকে আলাদা করে রোগীর দেহে প্রয়োগ করতে হয়, যা বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতির হাসপাতালে স্বল্প খরচে হলেও বেসরকারি মেডিকেলে বেশি লাগে। এ ছাড়া এ রোগের ওষুধগুলো বাইরের দেশের হওয়ায় দামও বেশি। ফলে অনেকে খরচ জোগাতে হিমশিম খান।’

বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতির উপদেষ্টা সৈয়দ দিদার বখত বলেন, ‘রোগটি নিরাময়ে এখন পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। ফলে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন, বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লানটেশন ও ওষুধ সেবন একমাত্র উপায়। কিন্তু উচ্চমূল্যের এই ট্রান্সপ্লানটেশন সবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আবার গ্রামাঞ্চলে থ্যালাসেমিয়া শনাক্তের ব্যবস্থা না থাকায় রক্তশূন্যতা মনে করে অনেকে ভুল করে আয়রন জাতীয় ওষুধ সেবন করছেন, যা রোগীকে মারাত্মক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতির উদ্যোগে কয়েক বছর আগে ১২শ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের ওপর এক জরিপ করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১০ থেকে ১২ শতাংশ থ্যালাসেমিয়া পজিটিভ ছিলেন। সমিতির উদ্যোগে এখন পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৫ হাজার মানুষের স্ক্রিনিং করা হয়েছে।

‘শিগগিরই পার্বত্য অঞ্চলে জরিপ চালোনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া রোগটির চিকিৎসার সঙ্গে জড়িতদের ধারণা, দেশে মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ১২ শতাংশ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। এর সঙ্গে প্রতি বছর নতুন করে ৯ থেকে ১২ হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু জন্ম নিচ্ছে।’

দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি…

এমন পরিস্থিতিতে রোগটি সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সারা বিশ্বের মতো রোববার দেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া ফেডারেশন এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে: ‘বি অ্যাওয়ার, শেয়ার, কেয়ার’ অর্থাৎ ‘থ্যালাসেমিয়া: নিজেই জানি, যত্নবান হই, অপরকে সচেতন করি।’